গুলশানের এক নামী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজে ঘেরা প্রাঙ্গণে বিকেলের আড্ডা, কফিশপের গন্ধ আর হালকা হাসাহাসির মাঝেই শুরু হয়েছিল ভ্যাবলা আর ঝাঁটুলীর পরিচয়। দুজনই ভিন্ন ভিন্ন বর্ষের ছাত্রছাত্রী—ভ্যাবলা দ্বিতীয় বর্ষে, আর ঝাঁটুলী তৃতীয় বর্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পড়ালেখার চাপের মধ্যেও পড়াশোনার সুবিধার জন্য গড়ে উঠেছিল একটি ছোট্ট স্টাডি গ্রুপ, যেখানে সদস্য ছিল কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী। সেখানেই একদিন ভ্যাবলা আর ঝাঁটুলীর প্রথম একসঙ্গে বসা, প্রথম আলোচনা, আর প্রথম পরিচয়ের সূত্রপাত।
প্রথমদিকে ভ্যাবলার কাছে ঝাঁটুলী ছিল শুধুই একজন সিনিয়র, যে ভালোভাবে বোঝাতে পারে কঠিন বিষয়গুলো, আর যে সবসময় আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে, অজান্তেই ঝাঁটুলীর মনে অন্যরকম কিছু জন্ম নিতে শুরু করে। ভ্যাবলার সরল হাসি, তার অবহেলামিশ্রিত সহজ স্বভাব, আর গম্ভীর অথচ উদাসীন দৃষ্টি যেন ঝাঁটুলীর ভেতরে এক অচেনা টান জাগিয়ে তোলে।
গ্রুপ স্টাডি চলতে থাকে নিয়মিত। লাইব্রেরির কোণে কিংবা ক্লাসরুমের ফাঁকা ঘরে সবাই মিলে বসে পড়াশোনা করলেও ঝাঁটুলীর চোখ সবসময় খুঁজে বেড়াত কেবল ভ্যাবলাকে। কখনো অজুহাত বানিয়ে তার পাশে বসা, কখনো খাতা এগিয়ে দেওয়া, কখনো প্রশ্নের উত্তর চাওয়ার ভান—সবকিছুতেই যেন ঝাঁটুলীর একান্ত ইচ্ছা ছিল ভ্যাবলার কাছে আরও একটু জায়গা করে নেওয়া।
ভ্যাবলা যখনই ক্লাসে প্রবেশ করত, ঝাঁটুলী অগত্যা এমনভাবে ব্যবস্থা করত যাতে তার পাশের সিট খালি থাকে। সহপাঠীদের কাছে এটা নিছক কাকতাল মনে হলেও ভ্যাবলা নিজেও টের পেত যে ঝাঁটুলীর আচরণের মধ্যে এক ধরণের বাড়তি যত্ন লুকিয়ে আছে। পরীক্ষার সময়ও ঝাঁটুলী ঠিক ভ্যাবলার পাশেই বসতে চাইত। পেনসিল, ইরেজার, ক্যালকুলেটর—সবকিছু বাড়তি রাখত কেবল এই কারণে যে, ভ্যাবলার যদি কোনো প্রয়োজন হয়, সে যেন সাথে সাথে দিতে পারে।
কিন্তু সমস্যা ছিল অন্যদিকে। ঝাঁটুলীর মনের ভেতরে যতটা গভীর আকর্ষণ জমে উঠছিল, ভ্যাবলার ভেতরে ঠিক ততটাই উদাসীনতা বিরাজ করত। সে ঝাঁটুলীকে সম্মান করত, কথা বলত, এমনকি মাঝে মাঝে মজা করতও, কিন্তু ভালোবাসা কিংবা টান—সে জিনিসগুলো ভ্যাবলার মনে সেভাবে জন্ম নিচ্ছিল না।
ঝাঁটুলী তবুও হাল ছাড়েনি। প্রতিদিন সে ভ্যাবলার প্রতিটি কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করত—ক্লাসে ঢুকতে দেরি করলে চিন্তায় অস্থির হয়ে যেত, সে যদি কারও সাথে বেশি কথা বলত তবে মনে হতো এক অজানা ঈর্ষা এসে জড়িয়ে ধরেছে। অনেক সময় ভ্যাবলার সামনে না বললেও রাতের অন্ধকারে ডায়েরির পাতায় লিখত তার অনুভূতি—
“আজও ওর চোখে আমি কিছু খুঁজলাম… কিন্তু পেলাম না। তবুও কেন মনে হয় একদিন না একদিন ও আমায় বুঝবেই?”
ভ্যাবলা এসব অনুভূতির গভীরতা পুরোপুরি বুঝতে পারত না। তার পৃথিবী তখনো অন্যরকম—স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, পড়াশোনা আর বন্ধুত্বের সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ। ঝাঁটুলীর যত্ন তার কাছে ছিল একপ্রকার মিষ্টি অভ্যাস, কিন্তু ঝাঁটুলীর ভালোবাসা যে ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে ফেলছে—সে ব্যাপারটা ভ্যাবলা এড়িয়ে যেত।
তবুও সময়ের সাথে সাথে এক অদ্ভুত টান তৈরি হতে লাগল। ভ্যাবলা হয়তো প্রেমে পড়ছিল না, কিন্তু সে অনুভব করছিল ঝাঁটুলীর উপস্থিতি ছাড়া দিনগুলো যেন একরকম ফাঁকা লাগে। ঝাঁটুলীর সেই নীরব যত্ন, পরীক্ষার সময় ছোট্ট সাহায্য, কিংবা অসুস্থ হলে হঠাৎ ওষুধ এনে দেওয়া—সব মিলিয়ে ভ্যাবলা অবচেতনভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিল তার এই অতিরিক্ত যত্নশীলতার সাথে।
অন্যদিকে, ঝাঁটুলীর অনুভূতি প্রতিদিন আরও গভীর হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, ভ্যাবলা হয়তো একদিন চোখ খুলে দেখবে, আর বুঝবে তার ভেতরে কতটা আন্তরিক ভালোবাসা জমে আছে।
কিন্তু ভবিষ্যৎ সবসময় মানুষের ইচ্ছে মতো সাজানো থাকে না। হয়তো ভ্যাবলা কখনোই ঝাঁটুলীর মতো গভীরভাবে অনুভব করবে না, আবার হয়তো সময়ের স্রোতে একদিন ভ্যাবলাও বুঝতে পারবে তার জীবনের অমূল্য সঙ্গী আসলে সেই সিনিয়র মেয়েটি—যে প্রথম দিন থেকেই তার পাশে বসার জন্য অজস্র অজুহাত বানাতো।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। ক্যাম্পাসের ব্যস্ত করিডর, ক্লাসের নিস্তব্ধতা, লাইব্রেরির ঘন নীরবতা—সব জায়গাতেই এক অদ্ভুত আবেগ ছড়িয়ে ছিল। ঝাঁটুলী নীরবে ভালোবেসে যাচ্ছিল, ভ্যাবলা উদাসীনভাবে সেই ভালোবাসার উষ্ণতায় ভিজে যাচ্ছিল, আর ভবিষ্যতের অধ্যায় তখনও লেখা বাকি ছিল।
ধন্যবাদ ভাই আমার বন্ধু লুচ্চা নিলয় কে নিয়া গল্প লিখের জন্য