আজকাল বিয়ের দাওয়াতের নামে সমাজে যে কাণ্ডকারখানা চলছে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—এটি আর ইবাদত নয়, বরং সুপরিকল্পিত এক প্রকার হোটেল ব্যবসা! যেখানে খাবার দেওয়া হয় না, খাবার বেচা হয়, অথচ সেটা আবার ধর্মীয় আবরণে মোড়ানো হয় যেন এটা কোনো মহৎ কাজ।
অতিথিকে খাওয়ানো ইসলামি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামতের দিবসে ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানের ইজ্জত করে।”
(বুখারি ও মুসলিম)
কিন্তু আজকের সমাজে দাওয়াতের নামে যা হচ্ছে, সেটা এই হাদীসের স্পষ্ট অপব্যবহার। কেউ একজন বিয়ে করছে, দাওয়াত দিচ্ছে, অথচ মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—”কে কত টাকা দিল, কয়জন লোক আসলো, কত খরচ উঠলো”—এই হিসেব। দাওয়াতের পরে বসে আয়-ব্যয়ের খতিয়ান কষা হয় ঠিক যেন একটি দোকানের বেচাকেনা শেষে লাভ-ক্ষতির হিসাব। আর যদি লাভ না হয়, তাহলে শুরু হয় অতিথিদের গালাগাল—”ওরাই তো এসে খেয়ে গেল, কিছু দিল না”, “ওদের মুখ দেখলে জ্বালা ধরে যায়”!
এ কেমন ইবাদত? ইসলামের কোন জায়গায় আছে যে দাওয়াত দিয়ে টাকা তুলতে হবে? বিয়ের দাওয়াত তো ইবাদতের অংশ, তা কি ব্যবসার মাঠে নেমে গেছে? যদি ইবাদত হয়, তাহলে তো এর ভিত্তি হবে খালিস নিয়্যত, আন্তরিকতা, আপ্যায়ন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যদি টাকা কামানোর উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে সেটা আর ইবাদত নয়—সরাসরি ধর্মের অপমান ও ইসলামকে ব্যবসার পণ্য বানানোর স্পষ্ট প্রমাণ।
আজকাল অনেকেই এমন কথা বলে থাকেন, “টাকা দিয়ে খাচ্ছি, তাহলে কম খাব কেন?”—এ বক্তব্য প্রমাণ করে দেয়, আজকের দাওয়াত আর দাওয়াত নেই, এটি হোটেল। আপনি আমন্ত্রণ জানিয়ে এক প্রকার জবরদস্তি করলেন মানুষের কাছে টাকা আদায় করতে। অথচ ইসলাম বলে,
“তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৮)
বিয়েকে কেন্দ্র করে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে—কে কত দামি খাবার দিল, কার বিয়ে কত জাঁকজমকপূর্ণ হলো—এটা একটা সামাজিক রোগ। এর সাথে ইসলাম বা সুন্নাহর কোনো সম্পর্ক নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“সবচেয়ে বরকতময় বিবাহ হলো সেই বিবাহ, যাতে খরচ কম হয়।”
(মুসনাদ আহমাদ)
সুতরাং, যারা দাওয়াত দিয়ে খরচ তুলতে চায়, তারা যেন বুঝে নেয়—এটা ইবাদত নয়, এটা ধর্মের নামে ছলনা। আর যারা দাওয়াত গ্রহণ করে মনে করে, “আমিও তো টাকা দিয়ে খাচ্ছি”—তারা যেন বুঝে নেয়, তারা হোটেলে খাচ্ছে, ইসলামের কোনো সুন্নাতে অংশ নিচ্ছে না।
এই প্রবণতা বন্ধ না হলে, বিয়ের দাওয়াত ইবাদতের স্থানে নয়, ইসলামের নামে হাস্যকর একটি প্রহসনে পরিণত হবে। আমরা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দাওয়াত দিই ও গ্রহণ করি—ব্যবসা বা প্রতিদান আশা না করে।