ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর চাইলে বেঁচে ফিরতে পারতেন। তাঁর হাতে ছিল একটি বোতাম—যেটি চাপলেই ইজেকশন সিট থেকে বের হয়ে প্যারাসুটে করে নিরাপদে নেমে আসা যেত। তাঁর মতো একজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পাইলট জানতেন কিভাবে জরুরি মুহূর্তে নিজেকে বাঁচাতে হয়। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন মৃত্যুকে—শুধু যেন সেই মৃত্যু কারও দরজায় না পৌঁছে যায়।
উত্তরার আকাশে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগ মুহূর্তেও তিনি লড়াই করেছেন। ককপিটে বসে শেষ চেষ্টা করেছিলেন যেন বিমানটি জনবহুল ভবন বা জনতার ভিড়ের উপর না পড়ে। তাঁর প্রাণের মূল্য দিয়ে রক্ষা করেছেন আরও শতাধিক প্রাণ। তাঁর মৃত্যু ছিল এক তরুণ অফিসারের নীরব বীরত্ব, এক অসীম দায়বোধের প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু এই আত্মত্যাগের পেছনে লুকিয়ে আছে এক নির্মম বাস্তবতা। তৌকিরের হাতে থাকা বিমানটি ছিল পুরনো এক F-7—যেটির উৎপাদন বন্ধ হয়েছে বহু আগেই। ১৯৭৬ সালের পুরনো নকশার এই যুদ্ধবিমান আধুনিক আকাশে উড়ার মতো না, উড়লে তা ঝুঁকির চেয়ে কিছুই বাড়ায় না। তবুও সেটিই উড়ছিল। কারণ আমাদের দেশের দুর্নীতি এখনো আকাশে উড়ে। বাজেটের নামে কাট-কমিশনের রাজনীতি এখনো প্রশিক্ষণের জায়গা দখল করে আছে। আর সেই ভার বইছে এই প্রজন্মের সাহসী অফিসাররা, যাঁরা দায়িত্ব পালনের মাঝে জীবন দিয়ে ফেলছেন।
তৌকির আসলে সেদিন আকাশে মারা যাননি। তিনি মরে গিয়েছিলেন সেই দিন, যেদিন কোনো আমলা টেবিলে সই করেছিলেন পুরনো বিমান দিয়েই চলবে প্রশিক্ষণ। যেদিন সিদ্ধান্ত হয়েছিল নতুন প্রযুক্তি আনা নয়, পুরনো কিছুতেই চলবে কাজ। যেদিন আধুনিকায়নের প্রয়োজনকে অগ্রাহ্য করে নিজের পকেট ভারী করা হয়েছিল। তৌকিরের মৃত্যুর পেছনে শুধু একটি দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল একটি ব্যর্থ সিস্টেম, ছিল রাষ্ট্রীয় অবহেলা, ছিল অমানবিক সিদ্ধান্তের দীর্ঘ ছায়া।
এই সিস্টেম তৌকিরকে কিছুই দেয়নি—না আধুনিক যন্ত্র, না নিরাপদ বিকল্প, না সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা। শুধু দিয়েছে একটি মরচে ধরা লোহা, একটি ঝুঁকিপূর্ণ উড্ডয়ন, আর একটি অবধারিত বিসর্জন।
উত্তরায় যে বিমান বিধ্বস্ত হলো, তার নিচে শুধু একজন অফিসার চাপা পড়েননি—চাপা পড়েছে বহু মানুষের জীবন, বহু পরিবারের ভবিষ্যৎ। নিহত হয়েছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পথচারী—আরও অনেক নাম, যাদের গল্প হয়তো খবরে আসেও না। যারা এখন হাসপাতালের বিছানায় পুড়ে ছটফট করছেন, যারা হয়তো সারা জীবন আর আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারবেন না, তারা সবাই এই অব্যবস্থাপনার শিকার।
আমরা শোক জানাই। তৌকিরসহ সকল নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। দোয়া করি আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু এই শোকেই যদি থেমে যাই, তবে তৌকিরের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। তাঁর সাহসকে সম্মান করতে হলে, আমাদের প্রশ্ন তুলতেই হবে।
একটি আধুনিক দেশের আকাশে এমন পুরনো যুদ্ধবিমান কেন উড়বে? কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে চলবে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ? কেন প্রতিবার দুর্ঘটনার পর শুধু মোমবাতি জ্বালিয়ে, ফুল দিয়ে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আমরা থেমে যাই?
তৌকির একটি প্রশ্ন রেখে গেছেন—তিনি একা নন। আমাদের সবার হয়ে প্রশ্ন করেছেন। সেই প্রশ্নটা হলো—আর কতজন মরলে এই সিস্টেম বদলাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর এখন জাতির কাছে। যদি আমরা সত্যিই চাই আর কোনো তৌকির যেন মরচে ধরা বিমানের সঙ্গে জীবন বিসর্জন না দেয়, তাহলে আমাদের সিস্টেমকে বদলাতে হবে। কারণ এমন মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তির নয়—এটা রাষ্ট্রের বিবেকহীনতার দলিল।