ঢাকার উত্তরা এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন কলেজে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিজের জীবন বাজি রেখে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরী। সেই দুর্ঘটনায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল পুরো এলাকা। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, চিৎকার, ছুটোছুটি। কিন্তু সে সময় শিক্ষার্থীদের অনেকেরই পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন মেহেরীন চৌধুরী—একজন শিক্ষিকা, যিনি ছিলেন দায়িত্বে, ছিলেন সাহসে, ছিলেন মানবিকতার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ধ্বংসযজ্ঞের মুহূর্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম থেকে বের করে আনতে শুরু করেন তিনি। ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে গিয়েও একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্বে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। একের পর এক শিক্ষার্থীকে নিরাপদে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর এক সদস্য জানিয়েছেন, শিক্ষিকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও উপস্থিত বুদ্ধির কারণেই কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু শিক্ষার্থীদের বাইরে বের করে দেওয়ার পর নিজে আর সময়মতো বের হতে পারেননি মেহেরীন চৌধুরী। আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে আটকে পড়েন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন। শরীরের একটি বড় অংশ পুড়ে গিয়েছিল। ভর্তি করা হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানেই লাইফ সাপোর্টে রেখে চিকিৎসা চলছিল। শেষ পর্যন্ত সোমবার, ২১ জুলাই, রাত ১১টার দিকে মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। একই রাতে আরও এক শিক্ষার্থী, আফনান নামের এক কিশোরও প্রাণ হারায়।
মেহেরীন চৌধুরীর এই আত্মত্যাগ শুধু একটি কলেজের গল্প নয়। এটি একটি জাতির বিবেকের গল্প। একজন শিক্ষক কীভাবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, তা মেহেরীন দেখিয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ছায়ার মতো আশ্রয়। তার সাহসিকতায় বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীরা আজও বলছে, “ম্যাডাম না থাকলে আমরা বাঁচতাম না।”
উদ্ধার হওয়া ছাত্রীদের মধ্যে একজন চতুর্থ শ্রেণির ছোঁয়া। দুর্ঘটনার সময় তার মামা চিৎকার করে খুঁজে ফিরেছেন ভাগনিকে। পরে জানতে পারেন, এক ‘ম্যাডাম’ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেনাবাহিনী তাদের জানিয়েছে, ওই ম্যাডামই ছিলেন মেহেরীন চৌধুরী। আরেক শিক্ষার্থী মেহেরিন জানায়, আহত অবস্থায় তিনিই ওই শিক্ষিকাকে ধোঁয়ার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেন এবং পরে উদ্ধারকারীদের সহায়তায় তাকে টেনে বের করে আনা হয়।
মেহেরীন চৌধুরী আজ আর নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া মানবিকতা, সাহসিকতা এবং দায়িত্ববোধ আজও মাইলস্টোন কলেজের প্রতিটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছে। তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন—তিনি হয়ে উঠেছেন একজন আদর্শ, একজন নায়ক, একজন শহীদ।