বৃহত্তর নোয়াখালী, যার অন্তর্ভুক্ত নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং ফেনী জেলা, বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল ‘ভুলুয়া’। ঐতিহাসিকভাবে, ভুলুয়া নামটি পরিবর্তিত হয়ে নোয়াখালী হয়েছে ১৬৬০-এর দশকে ডাকাতিয়া নদীর বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণে একটি নতুন খাল খননের কারণে। এই খাল খননের মাধ্যমে একটি নতুন শহর গড়ে ওঠে এবং “নোয়া” অর্থাৎ “নতুন” ও “খালী” অর্থাৎ “খাল” মিলিয়ে নাম হয় “নোয়াখালী”। এই ঘটনা প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক দিক থেকেও একটি বড় পরিবর্তন বয়ে আনে।
অর্থনৈতিকভাবে, বৃহত্তর নোয়াখালী কৃষিনির্ভর অঞ্চল। এখানকার উর্বর মাটি ধান, গম, সবজি ও নানা ফলমূল উৎপাদনের উপযোগী, যা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে কর্মরত, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইউরোপে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স শুধুমাত্র স্থানীয় অর্থনীতিকেই নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করছে। প্রবাসী নির্ভর অর্থনীতির কারণে এই অঞ্চলের গ্রামীণ অবকাঠামো ও জীবনযাত্রায় দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে।
বৃহত্তর নোয়াখালীর ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং মহাত্মা গান্ধীর সেই দাঙ্গা-পরবর্তী শান্তি মিশন। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে নোয়াখালীতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়াবহ সহিংসতা শুরু হয়। এই দাঙ্গা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের আগাম সংকেত বহন করছিল। সহিংসতা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, অনেক হিন্দু পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এরই প্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নোয়াখালী সফর করেন। তিনি প্রায় চার মাস ধরে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, প্রার্থনা সভা করেন এবং সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার বার্তা ছড়িয়ে দেন।
গান্ধীর এই সফর কেবল একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা ছিল না, বরং এটি সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর উপস্থিতি অনেকের মধ্যে সাহস ও আস্থা ফিরিয়ে আনে। যদিও দাঙ্গার ক্ষত পুরোপুরি মুছে যায়নি, তবুও গান্ধীর প্রচেষ্টা শান্তির পথে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই শান্তি মিশনের স্মারক হিসেবে আজও “Gandhi Ashram Trust” (গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট) নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে অবস্থিত। এটি মহিলাদের ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
এই অঞ্চলটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সামাজিক বৈচিত্র্য এবং অর্থনৈতিক অবদান—সব মিলিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালী বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, প্রবাসী আয়ের অবদান এবং শান্তির জন্য ঐতিহাসিকভাবে নেওয়া উদ্যোগগুলো এই অঞ্চলের পরিচয় বহন করে। অতীতের নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকায় বৃহত্তর নোয়াখালীর ভূমিকা আজও ইতিহাসচর্চা ও গবেষণার জন্য প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।