আসলে আমরা সবাই এক একটি অদৃশ্য যুদ্ধের সৈনিক। কারো বুকের ভেতর গুমরে কাঁদে শৈশবের অপূর্ণতা, কারো ভেতর জমে আছে হাজারো বিস্মৃত ক্ষত। কারো স্মৃতির ভিতর ঝুলে আছে না বলা কিছু কথা, কারো চোখের কোণে লুকিয়ে থাকে নিরব অভিমানের নদী। দিনের আলোতে আমরা মুখে হাসি এঁকে চলি, অথচ রাতে যখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়, তখন একা বিছানায় শুয়ে সেই হাসিগুলোই ভেঙে পড়ে কান্নার ভাষায়।
এমন নয় যে মানুষ বোঝে না, বরং তারা বোঝে না বলেই নিজেদের কল্পনায় আমাদের কষ্টকে ছোট করে ফেলে। আমরা যেটুকু বুঝিয়ে বলি, সেটুকুই তাদের জানা হয়, আর বাকিটুকু থেকে যায় অন্ধকারে — গভীর এক নীরবতা হয়ে। কেউ হয়তো বলে, “এত ভাবছো কেন? এগুলো কোনো ব্যাপার না!”
তারা জানে না, এ ‘না’ বলেই দিনের পর দিন বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টগুলো এক সময় পরিণত হয় আত্মার ভারে।
আমার হৃদয়ের ভাঙাগুলো যখন গুনে শেষ করতে পারি না, তখন আশেপাশের কেউ হয়তো বলে, “ও তো একবার কষ্ট পেয়েছিল, তারপর তো সব ঠিকঠাক।”
কি নির্মম সহজতায় তারা দুই লাইনে মুছে দেয় আমার দীর্ঘ সময় ধরে সয়ে যাওয়া যন্ত্রণার ইতিহাস। আমার কান্নার ভাষা তাদের কাছে নিছক এক আবেগপ্রবণ নাটক, আর আমার গভীর দুঃখ শুধুই ‘একটা সময়কার ব্যাপার’।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যটি হলো— মানুষ কেবল শুনতে চায় গল্প, কিন্তু সহানুভূতির চোখে দেখতে চায় না যন্ত্রণার গভীরতা। তারা ভালোবাসে সুখের পরিণতি, কিন্তু এড়িয়ে চলে বেদনার পথচলা।
তাই আজকাল অনেক কিছুই আর বলা হয় না। কিছু কিছু ব্যথা শুধু হৃদয়ের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়— নিজের জন্য, নিজের মতো। নিজের চোখের অশ্রুগুলো যখন নিজেকেই মুছতে হয়, তখন আর কাউকে দোষ দেওয়া যায় না।
আমার দুঃখ হয়তো কারো কাছে তুচ্ছ— কিন্তু আমার কাছে তা জীবনের সমান ভারী।
আমার নিরবতা হয়তো কারো কানে পৌছায় না— কিন্তু আমার বুকের গভীরে তা প্রতিধ্বনির মতো বাজে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।