জুলাই থেকে জুলাই: আরেক ফাইয়াজ, আরেক মৃত্যু, একই ব্যর্থতা

মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ক্লাস সেভেনের ছাত্র ফাইয়াজের জানাজা আজ ফজরের নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয় মিরপুরের পল্লবীতে। জানাজার সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের চোখে মুখে ছিল একধরনের হতবাক বিষণ্নতা—মাত্র গতকাল সকালের একটি রুটিন স্কুলডে, আর আজ সে নেই। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক হয়ে উঠেছে এই কিশোরটির মৃত্যুর গল্প, কারণ ফাইয়াজ গত দু’দিন ধরে অসুস্থ ছিল। জ্বর ছিল, দুর্বলতা ছিল। কিন্তু স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী কেউ যদি একটানা তিনদিন ক্লাসে না যায়, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই নিয়মের ভয়েই ২১ জুলাই সকালে, অসুস্থ শরীর নিয়েই স্কুলে যায় ফাইয়াজ।

তাকে বোঝানো হয়েছিল, “থাক আজ, না গেলে কিছু হবে না”—কিন্তু নিয়মের ভয়ে, হয়তো অভিভাবকদের সম্মান রক্ষায়, হয়তো সবার মতো “ভালো ছাত্র” হবার চেষ্টায় সে স্কুলে হাজির হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেদিনই বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আছড়ে পড়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের উপর। মুহূর্তেই পুড়ে যায় একটি ক্লাসরুম। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হয় একের পর এক দগ্ধ শিশুদের দেহ—যাদের একজন ছিল ফাইয়াজ।

এই মৃত্যুর ভয়াবহতা কেবল দুর্ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি অদ্ভুত ও নির্মম ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি। ঠিক এক বছর আগে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে, ঢাকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিল আরেকজন ফাইয়াজ। বয়স প্রায় একই, নাম এক, ভবিষ্যৎ এক রকম উজ্জ্বল। দুই ফাইয়াজ—দুই জুলাইয়ে শহীদ। এক বছর ব্যবধানে। দুটি আলাদা ঘটনার মাঝে যে মিল, তা কেবল মর্মান্তিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা এবং আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক নির্মম প্রমাণ।

এই প্রশ্নটা তাই আরও জোরালো হয়ে ওঠে—জুলাই এলেই কি আমাদের শিশুদের শহীদ হতে হবে? ক্লাসরুম কি আকাশ থেকে পড়া আগুনের লক্ষ্যবস্তু হবে? নিয়মের নামে কি অসুস্থ শরীরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে? রাষ্ট্রের ব্যর্থ নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায় কি কেবল “দুঃখ প্রকাশ”-এ শেষ হয়ে যাবে?

ফাইয়াজের মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা ছিল না। এটি ছিল আমাদের সিস্টেমেটিক অবহেলার একটি ফলাফল। স্কুলের নিয়ম, বিমানের রুট, অবহেলিত শিশু সুরক্ষা—সব কিছু মিলেই সে আজ আর বেঁচে নেই। আমরা হয়তো শোক জানাই, জানাজায় যাই, ফুল হাতে দাঁড়াই। কিন্তু তাতে কি আর কোনো ফাইয়াজ ফিরে আসে?

জুলাই থেকে জুলাই, আমরা ফাইয়াজ হারাই।

আর রাষ্ট্র ব্যস্ত থাকে প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিতে।

পরিবার হারায় সন্তান, আর সমাজ হারায় ভবিষ্যৎ।

এই দায় আর শুধু সরকারের নয়—এটা আমাদের সবার।

এখন সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার, প্রতিরোধ গড়ার।

না হলে আগামী জুলাইয়েও আরেক ফাইয়াজ আমাদের চোখের সামনে শহীদ হয়ে যাবে।

আমরা আবার লিখবো, কাঁদবো, ক্ষণিকের জন্য ক্ষুব্ধ হবো—তারপর আবার ভুলে যাবো।

যেমন ভুলে গেছি ২০২৪-এর ফাইয়াজকে।

তেমনই হয়তো একদিন ভুলে যাবো ২০২৫-এর ফাইয়াজকেও।

তবে ইতিহাস থেমে থাকে না। ফাইয়াজেরা চলে যায়, কিন্তু রেখে যায় প্রশ্ন।

আর সেই প্রশ্নগুলো যদি আজও আমরা শুনতে না পাই, তবে আগামী জুলাই আমাদের ক্ষমা করবে না।

Previous articleশেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শিক্ষকতা: মেহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ
Next articleবীরত্ব যখন সিস্টেমের ব্যর্থতার ছায়ায় ঢাকা পড়ে

Leave A Reply

Please enter your comment!
Please enter your name here