জুলাইয়ের শহরে—স্মৃতির বসুন্ধরা ও রমনার বৃষ্টি

সময়টা ২০১৬ সালের জুলাই। আকাশ প্রতিদিন এক অচেনা চিঠি লিখত মেঘ দিয়ে, আর আমি সেই চিঠির পাঠক হয়ে ঘুরে বেড়াতাম ঢাকার আনাচে-কানাচে। সেই দিনগুলোয় শহরটা যেন আমার সঙ্গী ছিল—কখনো নিঃশব্দ শ্রোতা, কখনো গল্প বলা বন্ধু।

বসুন্ধরা তখন সদ্য গজিয়ে ওঠা উচ্চ ভবনের ছায়ায় আধুনিকতার মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটের মাঝে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হতো, শহর নিজেই নিজের চেহারা পাল্টে নিচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যেও কোথাও এক শূন্যতা ছিল—একটা চাপা নৈঃশব্দ্য, যা আমার মতো পথচারীর মনে প্রশ্ন তুলত: এই শহরের ভেতরে সত্যিকারের ‘বসতি’ কি আছে? নাকি কেবল কংক্রিটের ফাঁকে হাঁপ ধরা শূন্যতা?

মাঝেমাঝে, সেখানকার কোনো নির্জন সড়কে বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকতাম। মাথার ওপরে ছাতা থাকত না, কিন্তু মন ছায়া খুঁজত। হয়তো কাশফুলের মতো ভেসে যেতো কোনো পুরনো গান—“এই শহরে কেউ নেই আমার”—আর চারপাশটা হঠাৎ করেই যেন থেমে যেত।

অন্যদিকে ছিল রমনা পার্ক। সেখানে জুলাইয়ের বৃষ্টি ছিল যেন এক নিঃশব্দ আরতি। বিশাল গাছগুলোর পাতায় পানি জমে থাকত, আর মাঝেমধ্যে তা টুপ করে পড়ে মনকে চমকে দিত। সে সময় সেখানে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতো, শহরের কোলাহল থেকে এটা যেন এক কুয়াশামাখা স্মৃতির আঙিনা। বয়সী দম্পতির হাতে হাত ধরে হাঁটা, একাকী পাঠকের ছায়ায় বসে থাকা, কিংবা ছাতা ছাড়া ভিজতে থাকা কিশোরীর নির্ভীকতা—সব মিলিয়ে রমনা ছিল এক বেঁচে থাকা কবিতা।

একদিন বিকেলে, টলমলে পাথরের বেঞ্চে বসে থাকা অবস্থায় এক পাখি এসে বসেছিল সামনে। কোনো শব্দ ছিল না চারপাশে, শুধু দূরের গায়ে বৃষ্টির শব্দ। সেই মুহূর্তে রমনা যেন ঢাকার নয়, বরং আমার মনেরই এক প্রতিবিম্ব ছিল।

এখন এসব শুধু স্মৃতি। বসুন্ধরার রাস্তাগুলো বদলে গেছে, নতুন ভবন উঠেছে আরও অনেক, রমনার গাছগুলো হয়তো আরও একটু পুরোনো হয়েছে। কিন্তু আমার সেই জুলাই—সে তো এখনও একই আছে, এক পৃষ্ঠা খোলা ডায়েরির মতো, যেখানে এখনো লিখে রাখা আছে কিছু না-বলা কথা, কিছু ভেজা বিকেল, কিছু একা হাঁটা।

স্মৃতি তো এমনি করেই বেঁচে থাকে—নতুন শহরের ভিড়ে পুরনো ঢাকার কিছু কর্নারে, বসুন্ধরার ভেজা গলিতে, রমনার ছায়া-পথে, কিংবা কোনো অলস দুপুরে মনে পড়ে যাওয়া এক বৃষ্টির দিনে।

Previous articleনিজের কাছে নিজের দুঃখ পাহাড় সমান, অন্যের কাছে দুই লাইনের গল্প।
Next articleপরিচালনার নীতিমালা: আধুনিক সংগঠন পরিচালনার মূল ভিত্তি

Leave A Reply

Please enter your comment!
Please enter your name here