গ্রামের নির্জন এক কোণে, প্রাচীন কদম গাছের তলায়, তিনজন চরিত্র যেন আলাদা আলাদা জগত থেকে এসে মিলেছিল—টুকটুকি, কুটিকুটি আর গিরগিটি।
টুকটুকি ছিল শান্ত-শিষ্ট, কোমল হৃদয়ের মেয়ে। তার চোখে ভোরের শিশিরের মতো নির্মল স্বপ্ন ছিল, যার হাসিতে গ্রীষ্ম দুপুরের ক্লান্ত মানুষও স্বস্তি পেত। সে সহজ-সরল, আড়ম্বরহীন, আর তাই তার মায়ার আবরণে যে কেউ হারিয়ে যেতে পারত।
অন্যদিকে কুটিকুটি ছিল একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের। সে হাসিখুশি, চঞ্চল, অস্থির জলের ঢেউয়ের মতো প্রাণবন্ত। তার উপস্থিতি মানেই চারপাশে আলোড়ন—কথায়, ভঙ্গিতে, চোখের চাহনিতে একরাশ ঝলমলানি লুকিয়ে থাকত।
আর গিরগিটি—তার চরিত্র ছিল সবচেয়ে জটিল। বাইরে থেকে ভদ্র, শান্ত, সংযত—যেন নরম কণ্ঠে কথা বলা, সবসময় সৌজন্যের মুখোশ পরে থাকা এক মানুষ। কিন্তু সেই মুখোশের আড়ালে লুকানো ছিল আকর্ষণ আর অস্থিরতার খিদে।
গিরগিটি বহুদিন ধরেই টুকটুকিকে মন থেকে ভালোবাসার ভান করে চলছিল। টুকটুকির নিরীহ সরলতায় সে এক ধরণের আশ্রয় খুঁজে পেত, যদিও তার ভালোবাসা ছিল না সম্পূর্ণ সত্যের। একদিন সাহস সঞ্চয় করে গিরগিটি টুকটুকির সামনে নিজের অনুভূতির কথা জানাল। কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে বলল—
“টুকটুকি, তোমাকে ছাড়া আমার জীবনের কোনো মানে নেই। তুমি আমার জীবনের একমাত্র আলো।”
টুকটুকি প্রথমে অবাক হলেও তার সরল হৃদয় দ্রুত নরম হয়ে যায়। সে বিশ্বাস করে বসে—হ্যাঁ, গিরগিটির কথাগুলো সত্যি। এভাবেই তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের বন্ধন। দিনগুলো ভরে ওঠে ছোট ছোট মুহূর্তে—কখনো তারা বৃষ্টিভেজা বিকেলে পাশাপাশি হাঁটে, কখনো নদীর ধারে বসে গল্প করে, আবার কখনো রাতের আকাশে তারা গুনতে গুনতে নিজেদের স্বপ্ন আঁকে। টুকটুকি ভেবেছিল, সে পেয়েছে জীবনের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
কিন্তু মানুষের মনের মতোই গিরগিটির মনও ছিল রঙ বদলানোর। কিছুদিন পরেই কুটিকুটি এসে উপস্থিত হয় তাদের জীবনে। কুটিকুটি আলাদা ধরনের মাধুর্য নিয়ে আসে। তার হাসি, তার প্রাণবন্ত কথা, তার সাহসী ভঙ্গি গিরগিটির ভেতরে নতুন আলোড়ন তোলে। প্রথমে সে শুধু বন্ধুত্বের অজুহাতে কুটিকুটির কাছে যায়, কিন্তু ধীরে ধীরে টুকটুকির প্রতি তার মনোযোগ কমতে শুরু করে। কুটিকুটির প্রতি এক অদ্ভুত টান তাকে প্রতিদিন টেনে নিয়ে যায়।
গিরগিটি বুঝতে শুরু করে, সে যেন দুই ভিন্ন জগতের মাঝে দাঁড়িয়ে। একদিকে টুকটুকির স্নিগ্ধ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা; অন্যদিকে কুটিকুটির দীপ্তি, রঙিন আকর্ষণ। সে একদিকে টুকটুকির সঙ্গে আগের মতোই মধুর কথা বলে যায়, অন্যদিকে গোপনে কুটিকুটির সঙ্গেও সময় কাটায়। এই দ্বিমুখী খেলার মধ্যে সে নিজেই বুঝতে পারে না কোনটা আসল, কোনটা মিথ্যা।
দিনগুলো এভাবেই গড়াতে থাকে। গিরগিটি ভাবে—“আমি তো শুধু আমার জীবনের সেরাটাই খুঁজছি। টুকটুকির শান্তি, কুটিকুটির ঝলকানি—দুটো একসাথে যদি পাওয়া যায়!” কিন্তু সে বোঝে না, ভালোবাসা কখনো হিসেবের খেলা নয়, মুখোশের আড়ালে রাখা যায় না।
হঠাৎ একদিন টুকটুকির কানে পৌঁছে যায় সত্যিটা। প্রথমে সে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু যখন প্রমাণ চোখের সামনে আসে, তখন তার হৃদয় যেন মুহূর্তেই ভেঙে যায়। সে বুঝতে পারে, যে মানুষটিকে এতদিন ভদ্রতার আচ্ছাদনে ভরসা করেছে, সে আসলে প্রতারণার এক নকশা বুনছিল। টুকটুকির বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। অঝোর চোখের জলে সে বলে ওঠে—
“গিরগিটি, তুমি আসলে কখনোই আমাকে ভালোবাসোনি। তুমি শুধু ভদ্রতার মুখোশ পরে আমার সামনে দাঁড়িয়েছিলে।”
সেই দিন থেকে টুকটুকি নিজেকে গিরগিটির জীবন থেকে সরিয়ে নেয়। ভাঙা হৃদয় নিয়ে সে নিজের পথ বেছে নেয়। তার চোখে দুঃখ থাকে, কিন্তু সেই দুঃখ তাকে শক্ত করে তোলে।
গিরগিটি তখনও কুটিকুটির পাশে থাকে, কিন্তু তার ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা জমতে শুরু করে। সে বুঝতে পারে, যাকে হারিয়েছে সে-ই ছিল সত্যিকারের আশ্রয়। কুটিকুটির ঝলকানিতে সে সুখ খুঁজে পায় না, আর নিজের ভেতরের ভণ্ডামির বোঝায় দম বন্ধ হয়ে আসে।
টুকটুকি অনেক দূরে চলে যায়, আর গিরগিটি রয়ে যায় নিজের রঙ বদলানো জীবনের অস্থিরতায়। যে ভদ্রতার মুখোশ সে এতদিন পরে ছিল, তা খুলে গেছে—এবার সবার সামনে প্রকাশ পেয়েছে তার আসল চেহারা।
শেষ পর্যন্ত টুকটুকির জন্য কোনো আফসোস রয়ে গেল না, কারণ সে জানত—প্রতারণার ওপর কোনো সম্পর্ক কখনো টিকে না। কিন্তু গিরগিটির জীবন হয়ে উঠল অন্তহীন অনিশ্চয়তা, দ্বিধা আর একাকিত্বে ভরা।