একটি চিপস, একটি প্রাণ, আর আমাদের নীরব সমাজ

আজ একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেই মনটা ভার হয়ে গেল। একটি শিশুর আত্মহত্যার খবর, সত্যিই অপ্রত্যাশিত ও বেদনাদায়ক। এতটুকু একটি প্রাণ, যে এখনও জীবনের মানে বোঝার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল – এটা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়।

প্রথম প্রশ্নটাই ঘুরে ফিরে আসে – এই শিশুটির মানসিক অবস্থার এতটাই অবনতি হলো কেন? সে কি কাউকে তার কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল? জীবনের আসল সংগ্রামটা টিকে থাকার, আত্মহত্যা কখনোই সমাধান হতে পারে না। কিন্তু তাকে এই সহজ ‘সমাধান’-এর পথটাই বেছে নিতে হলো, কারণ হয়তো কাউকে পাশে পায়নি।

ধরা যাক, অভিযোগ সত্যি – সে হয়তো চিপস চুরি করেছিল। কিন্তু সেটাই কি এত বড় অপরাধ? দশ টাকার দুটি চিপসের প্যাকেট কি এতটাই মূল্যবান হয়ে উঠল যে তার বিনিময়ে একটা প্রাণ হারাতে হবে? সমাজে প্রতিদিন কত বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে – শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, এমনকি শিশু ও নারীদের ক্ষেত্রেও। সেই সব চুরির বিরুদ্ধে আমরা নীরব, অথচ শাস্তি দিই সেই দুর্বল, নিরীহ ছোট্ট প্রাণকে।

আমরা প্রতিবাদ করতে শিখিনি। শুধু দুর্বলদের উপর ক্ষমতা খাটাতে পারি। অথচ শাসন এমন হওয়া উচিত যা শিক্ষা দেয়, ক্ষত নয়। শাসনের ভাষা যদি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়, তাহলে সেটা শুদ্ধি নয়, নির্যাতন।

আমি আমার জীবনের পাঁচ থেকে সাত বছর শিশুদের সঙ্গে কাজ করে কাটিয়েছি, এবং এখনও সুযোগ পেলেই তাদের সঙ্গে সময় কাটাই। আমি জানি, শিশুরা কীভাবে জিনিসপত্রের প্রতি আগ্রহী হয়। তাদের চোখে যা ভালো লাগে, তারা সেটি নিজের করে রাখতে চায়। কেউ লুকিয়ে রাখে, কেউ অনেকবার দেখে রাখে, কেউ আবার বন্ধুর জিনিস নিজের ব্যাগে নিয়ে চলে আসে – এটা কৌতূহল, চুরি নয়। কারণ এই বয়সের শিশুরা চুরির অর্থ বা তার পরিণতি বোঝে না।

তাদের সবচেয়ে বড় নির্ভরতার জায়গা হলো মা। একজন মা-ই পারেন শিশুর মানসিক জগতকে স্থির এবং সাহসী করে তুলতে। একজন মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা এবং বোঝাপড়া যদি দুর্বল হয়, তাহলে শিশুটি চুপচাপ ভেঙে পড়ে। সে তখন জীবনের ছোট ছোট সমস্যাকেও দানব মনে করে।

একবার একজন জ্ঞানী বলেছিলেন – মায়ের উষ্ণতার পরিমাপেই সন্তানের মানসিক দৃঢ়তা গড়ে ওঠে। তাই, যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, প্রতিদিন সন্তানের জন্য কিছুটা সময় রেখে দিন। তারা যে অপমান বা অবহেলাকে গভীরভাবে অনুভব করে, সেটি বুঝতে শিখুন। কারণ এই অনুভবই কখনও কখনও আত্মবিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে।

এইরকম তুচ্ছ এক ঘটনার জন্য যেন আর কোনো নিষ্পাপ প্রাণ অকালে নিভে না যায় – এটাই আমাদের সবার দায়িত্ব। প্রতিটি শিশুই একটি সম্ভাবনা, একটি ভবিষ্যৎ। তাদের ভালোবাসা ও বোঝার প্রয়োজনে আমরা যেন কখনো কার্পণ্য না করি।

Previous articleআসমানীর গল্প
Next article“অভ্যন্তর” – অন্তরের ভেতরের অনুভূতির একান্ত ছবি

Leave A Reply

Please enter your comment!
Please enter your name here